শেষ দশকে ইতিকাফ

শেষ দশকে ইতিকাফ
আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের উদ্দেশে বিশেষ নিয়তে, বিশেষ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ একটি বিশেষ ইবাদত। মদিনায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ পুরো মহল্লার কেউ ইতিকাফ না করলে সবাই গুনাহগার হবে। আর একজনও যদি আদায় করে, তাহলে সবাই রেহাই পাবে। এই ইতিকাফের জন্য রমজানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। আর ঈদের চাঁদ উদিত হলে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। তবে ঈদের নামাজ আদায় করে বের হওয়া উত্তম। কেননা এতে ঈদের রাতে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত করা যায়।

ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্য সব বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। কোরআনুল কারিমে বিভিন্নভাবে ইতিকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫) 

হাদিসেও ইতিকাফ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ইন্তেকাল পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন, এরপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৮, মুসলিম, হাদিস : ২০০৬) 

আবু হুরাইরা (রা) বলেন : ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩) 

ইতিকাফের রুকন হলো মসজিদে অবস্থান করা। হানাফি মাজহাব মতে ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত। মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফিরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না। ইতিকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ শুদ্ধ হতে পারে না। ভালোমন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভালোমন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না। ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো ইতিকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে। আর এ দুটির মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন। রাসুল (সা.) তো বলেছেন : ‘প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের ওপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তা-ই পাবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১)  

বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী সবচেয়ে কম সময়ের ওয়াজিব ইতিকাফ হলো, এক দিন-এক রাত কিংবা এর বেশির ভাগ সময়। তবে নফল ইতিকাফ অল্প সময়ের জন্য, এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও হতে পারে বলে ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) মত দিয়েছেন। সর্বোচ্চ কত দিনের জন্য ইতিকাফ করা যায়—এ ব্যাপারে ওলামাদের মতামত হলো, এ ব্যাপারে নির্ধারিত কোনো সীমারেখা নেই।

ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ। বাইতুল্লাহ শরিফের পর মসজিদে নববী। এরপর বাইতুল মুকাদ্দাস। তারপর জুমা আদায় করা হয় এমন মসজিদ। এরপর মহল্লার যে মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেশি হয়। ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে ইমাম জুহুরি (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) অনেক নফল কাজ কখনো করতেন, কখনো ছেড়ে দিতেন। কিন্তু মদিনায় হিজরত করার পর থেকে ওফাত পর্যন্ত কখনো রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ কাজা করেননি। আফসোসের বিষয়, মানুষ তাঁর পুরোপুরি পাবন্দি করে না। 

এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইতিকাফকারী গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার জন্য আমল করা ছাড়াই অন্য নেককারদের ন্যায় নেকি বরাদ্দ করা হয়।’ 

অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, তাকে দুটি হজ ও দুটি ওমরাহ পালন করার সাওয়াব দান করা হবে।’ 

কাজেই এটি সাওয়াব হাসিলের মহা সুযোগ। পুরুষের মতো নারীরাও ইতিকাফ করতে পারবে। এ জন্য উল্লিখিত শর্তাবলির সঙ্গে স্বামীর অনুমতির বিষয়টি যোগ করতে হবে। আর নারীরা ঘরের কোণে আলাদা কোনো বিশেষ স্থানে ইতিকাফ করবেন। এমন কিছু কাজ রয়েছে, যা করার দ্বারা ইতিকাফ ভেঙে যায়। যেমন—মসজিদ বা ইতিকাফের স্থান থেকে কোনো প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া। ইতিকাফ অবস্থায় ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা। অজ্ঞান, পাগল বা মাতাল হয়ে যাওয়া। নারীদের মাসিক শুরু হওয়া। গর্ভপাত হওয়া। সহবাস করলে। বীর্যপাত ঘটলে। ইতিকাফকারীকে জোরপূর্বক মসজিদ বা ইতিকাফের স্থান থেকে বের করে দিলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। একান্ত প্রয়োজনসহ আরো কিছু কারণে ইতিকাফকারী মসজিদ বা ইতিকাফের স্থান থেকে বাইরে বের হতে পারবেন। আর তা হলো প্রস্রাব-পায়খানা। ফরজ গোসল। খাবার পৌঁছে দেওয়ার লোক না থাকলে খাবার খাওয়ার জন্য। যে মসজিদে ইতিকাফ করছেন সেটা যদি জামে মসজিদ না হয়, তাহলে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য ইত্যাদি অবস্থায় ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন। 


Previous
Next Post »