পর্দা বিষয়ক অহেতুক কিছু অজুহাতের উত্তর-সমাধান

islam o jibon news
পর্দা
কেন পর্দা করেন না? প্রশ্নটি করা হয়েছিল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার নারীদের কাছে। যেসব কারণ তারা দেখিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দশটি কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। চেষ্টা করেছি এগুলোর উত্তর খোঁজার। কারণগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে আমরা খুঁজে পেয়েছি এসব অজুহাতগুলোর দুর্বলতা। প্রিয় মুসলিম বোন, আমাদের এই গবেষণা-পুস্তিকায় আমরা গুরুত্ব অনুসারে সেসব কারণ এবং সংক্ষেপে এই কারণগুলোর ব্যাপারে আমাদের আলোচনা উপস্থাপন করেছি। যারা পরিপূর্ণ পর্দার ব্যাপারে আগ্রহী নন, কিংবা পর্দার গুরুত্ব বোঝা সত্ত্বেও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে পর্দা শুরু করতে পারছেন না আশা করি সবার জন্যই এই লেখাটি কাজে দেবে।
অজুহাত : ইসলামিক পোশাকের ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমার বাবা-মা আমাকে হিজাব পড়তে বারণ করেন। বাবা-মার নিষেধাজ্ঞা না মানলে আমি কি জাহান্নামে যাব না?
উত্তর : এই অজুহাতের উত্তর বহু আগেই দিয়ে গেছেন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ নাবী মুহাম্মাদ (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। প্রজ্ঞাগুণে অল্প কয়েকটি কথায় তিনি এর উত্তরে বলেছেন, “যে কাজে স্রষ্টার অবাধ্যতা করা হয়, সেই কাজে স্রষ্টা বাদে অন্য কারও বাধ্য হওয়া যাবে না।” (আহমাদ : ১০৪১)
সন্দেহ নেই, ইসলামে মা-বাবার মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। বিশেষ করে মাকে দেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা। আল্লাহর ইবাদাহ ও তাওহীদের মতো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয়ের সঙ্গে একই আয়াতে মা-বাবার সাথে ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর উপাসনা করো, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। আর মা-বাবার সাথে ভালো আচরণ করো।” [সূরাহ আন-নিসা, ৪:৩৬]
তাই সকল ক্ষেত্রেই মা-বাবার বাধ্য থাকতে হবে, কেবল একটি মাত্র ক্ষেত্র ছাড়া। সেটা হচ্ছে মা-বাবা যদি কখনো এমন কোনো কাজ করতে বলেন, যেটা আল্লাহর বিধিনিষেধের নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে। আল্লাহ বলেছেন, “কিন্তু তারা যদি এই চেষ্টা করে, যাতে তুমি আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না...” [কুরআন ৩১:১৫]
অন্যায় কাজে তাদের অবাধ্য হওয়ার মানে এই না যে, আমরা তাদের সাথে ভালো আচরণ করব না, তাদের যত্ন নেব না। কারণ, এই একই আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, “তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে।”
সংক্ষেপে : মা-বাবাকে উপযুক্ত সম্মান করবেন, তাদের সাথে ভালো আচরণ করবেন; কিন্তু তাই বলে এমন কোনো কাজে তাদের বাধ্য হওয়া যাবে না, যে কাজে আল্লাহর অবাধ্যতা করতে হয়।
অজুহাত : এত গরম আমাদের দেশে, একদমই সহ্য করতে পারি না। এত গরমে কীভাবে হিজাব করব?
উত্তর : গরমের তীব্রতা কত মারাত্মক হতে পারে এ ব্যাপারে আল্লাহ বলছেন, “ওদের বলো, জাহান্নামের আগুন আরও বেশি গরম; যদি তারা বুঝত!” [সূরা আত-তাওবাহ, ৯:৮১]
নরকের আগুনের তীব্রতার সাথে এই দুনিয়ার তাপমাত্রার তুলনা কীভাবে সম্ভব! বোন, জেনে রাখুন—শয়তান আসলে আপনাকে এমন এক ফাঁদে ফেলেছে, এমন এক জাল বুনেছে আপনার সামনে, যে জাল ছিঁড়ে গেলে পৃথিবীর এই সামান্য উত্তাপ থেকে আপনি গিয়ে পড়বেন জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুনে। শয়তানের এই ফাঁদ থেকে বেড়িয়ে আসুন। সূর্যের উত্তাপকে নিগ্রহ না ভেবে মহান আল্লাহর একটা অনুগ্রহ হিসেবে ভাবুন। কেননা সূর্যের এই উত্তাপ আপনাকে সেই সত্যকে মনে করিয়ে দেয় যে, জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা এর চেয়ে আরও কত লক্ষ কোটি গুণ বেশি! যে গরম আপনি এখন সহ্য করছেন, জাহান্নামের উত্তাপের তুলনায় তা কিছুই নয়। তাই পার্থিব আয়েশ ত্যাগ করে ফিরে আসুন আল্লাহর আনুগত্যের ছায়াতলে। গায়ে তুলে নিন নিরাপত্তার আবরণ। নিজেকে বাঁচান জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে। যে শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, “সেখানে তারা কোনো ঠাণ্ডা বস্তুর স্পর্শ পাবে না; ফুটন্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছাড়া অন্য কোনো পানীয়ের স্বাদ পাবে না।” [সূরা আন-নাবা, ৭৮:২৪-২৫]
অজুহাত : হিজাব করলে কেউ আমাকে বিয়ে করবে না। তাই, বিয়ে করার আগ পর্যন্ত আমি হিজাব করব না।
উত্তর : কোনো স্বামী যদি আপনাকে পর্দাহীন রাখতে চায়, জনসম্মুখে আপনার সৌন্দর্য প্রদর্শনে তার কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে সে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করল। সত্য কথা বলতে, এ ধরনের পুরুষ আপনার স্বামী হওয়ারই যোগ্য নয়। আল্লাহ আপনাকে যেটা করতে বলেছেন, সেই বিধান রক্ষায় যার কোনো মাথা ব্যাথা নেই, সে লোক আপনার জান্নাতে প্রবেশের বাধা বৈ আর কিছু নয়। বরং এ ধরনের স্বামীরা আপনার জাহান্নামে যাওয়ার পথকেই আরও সুগম করবে। আল্লাহর অবাধ্যতায় যে ঘরের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে, যে পরিবারে অহরহ এমন কাজ করা হয় যাতে আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন, এমন ঘরে পার্থিব জীবনে সবসময় দুঃখকষ্ট ও দুর্দশা লেগেই থাকবে। আর পরকালের সীমাহীন দুর্ভোগ তো আছেই। কারণ আল্লাহ বলেছেন, “যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে (অর্থাৎ এই কুরআনে বিশ্বাস করবে না, কিংবা এই কুরআনের বিধিনিষেধ মেনে চলবে না) তার জন্য রয়েছে কষ্টের জীবন; আর পুনরুত্থানের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় ওঠাব।” [সূরাহ তাহা, ২০:১২৪]
বিয়ে আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। কার সাথে কার বিয়ে হবে এটা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। আপনি কতজন নারীকে দেখেছেন যারা হিজাব করছেন অথচ তাদের বিয়ে হয়নি? অন্যদকে কতজন নারীকে দেখেছেন যারা হিজাব করে না এবং অবিবাহিত? আপনি যদি বলেন যে হিজাব না করার পেছনে মূল কারণ বিয়ের মতো পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, তাহলে একটি কথা জেনে রাখুন, অপবিত্র বা খারাপ কাজের মাধ্যমে ইসলামে কখনো ভালো কিছু অর্জন করা যায় না। উদ্দেশ্য যদি আসলেই মহৎ কিছু হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই বৈধ ও পবিত্র উপায়ে অর্জন করতে হবে।
অজুহাত : আমার বয়স অনেক কম, হিজাব করার সময় আমার হয়নি এখনো বা বয়স হলে হজ করার পর পর্দা করব
উত্তর : বোন আমার, মৃত্যুর দূত আপনার আশেপাশেই ঘুরছে। যেকোনো সময়ই সে আপনার প্রাণ হরণ করে নেবে। শুধু আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা। আল্লাহ বলেছেন, “যখন তাদের মৃত্যুর সময় আসবে, তখন তারা এক মুহূর্তও এদিক সেদিক করতে পারবে না।” [সূরাহ আরাফ, ৭:৩৪]
আপনার বয়স কম না বেশি সে জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। হয়তো এমন সময় আপনার মৃত্যু এসে পড়বে, যখন কিনা আপনি ডুবে আছেন পাপাচার, অবাধ্যতা ও আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণে। হয়তো এমন সময় আপনার মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠবে যখন আপনি পরিপূর্ণ পর্দা ছাড়াই বাইরে বের হয়েছেন কিংবা গায়ে জড়িয়েছেন আপত্তিকর কোনো পোশাক। বোন আমার, অন্যায় ও পাপকাজের রেসে না-নেমে, যারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দ্রুতলয়ে তাঁর পানে অগ্রসর হচ্ছে আপনি তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামুন। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রতিযোগিতা করো, যে জান্নাতের ব্যপ্তি মহাকাশ ও পৃথিবীর ন্যায় প্রশস্ত। এমন জান্নাত প্রস্তুত রাখা হয়েছে শুধু তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর বার্তাবাহককে বিশ্বাস করে।” [সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭:২১]
বোন, আল্লাহকে ভুলে যেয়েন না, তাহলে এই দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহও আপনাকে ভুলে যাবেন। আপনার উপর থেকে তাঁর দয়া, মায়া, মমতার দৃষ্টি তুলে নেবেন। আল্লাহকে যথাযথভাবে উপাসনা না করে, তাঁর আনুগত্য না করে আপনি আপনার আত্মার হক আদায় করছেন না, ভুলে যাচ্ছেন আপনার নাফ্সের কথা। ভণ্ডদের ব্যাপারে আল-কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “ওদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে যায়, যার ফলে আল্লাহও তাদেরকে তাদের নিজেদের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন।” [সূরাহ আল-হাশ্র, ৫৯:১৯]
বোন, পাপের বোঝা ভারি না করে অল্প বয়স থেকেই হিজাব করা শুরু করুন। কেননা, আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর। পুনরুত্থানের দিনে তিনি আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব নেবেন।
অজুহাত : হিজাব বা পরিপূর্ণ পর্দা করলে লোকজন আমার গায়ে বিভিন্ন ইসলামিক দলের তকমা লাগিয়ে দেবে। আর আমি এসব দলাদলি মোটেও পছন্দ করি না।
উত্তর : বোন, ইসলামে মাত্র দুটো দল আছে। মহান আল্লাহ তাঁর গ্রন্থে এই দুটো দলের নামই উল্লেখ করে দিয়েছেন। প্রথম দল হচ্ছে আল্লাহর দল। তাঁর আদেশের আনুগত্য এবং তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকার কারণে, এই দলটিকে তিনি চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন। আর দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে, অভিশপ্ত শয়তানের দল। এরা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং পৃথিবীত অশান্তি সৃষ্টি করে। আপনি যদি আল্লাহর আদেশের অনুসরণ করেন—যার মধ্যে হিজাব একটি—তাহলে আপনি সাফল্য লাভকারী আল্লাহর দলের একজন গর্বিত সদস্য। কিন্তু যখন আপনি পরিপূর্ণ পর্দা করেন না, আল্লাহর বিধিনিষেধ মানেন না, আপনার সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ান, তখন আপনি শয়তানের নৌকোয় উঠে বসলেন। আপনি তখন গলা মেলালেন শয়তানের সঙ্গী-সাথী, ভণ্ড-মুনাফিক ও অবিশ্বাসী-কাফিরদের সাথে। বন্ধু হিসেবে এদের চেয়ে জঘন্য আর কে আছে?
আপনি কি টের পাচ্ছেন না, কীভাবে আপনি আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, আর ধীরে ধীরে শয়তানের গুহায় প্রবেশ করছেন? বোন আমার আল্লাহর দিকে এগিয়ে যান, তাঁর নির্দেশনা মেনে চলুন: “আল্লাহর শাস্তি থেকে আল্লাহর রহমতের দিকে ধাবিত হও। আমি (মুহাম্মাদ) তোমাদের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে একজন সতর্ককারী।” [সূরাহ আয-যারিয়াত ৫১:৫০] হিজাব বা পরিপূর্ণ পর্দা করা একটি উচ্চ পর্যায়ের ইবাদাত। কোনো লোকের মতামত বা ব্যক্তিগত পছন্দ, কোনো দলের পরিচিতির সাথে এর কোনো লেনাদেনা নেই। হিজাবের বিধান দিয়েছেন মহাজ্ঞানী স্রষ্টা আল্লাহ।
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান
Previous
Next Post »