কেমন ছিলো খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগের ব্যবসা-বাণিজ্য?

islam o jibon
কেমন ছিলো খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগের ব্যবসা-বাণিজ্য?
সুপ্রাচীন কাল থেকেই মক্কা বাণিজ্য নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। আরব উপদ্বীপের অনেক অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা লুণ্ঠন হলেও মক্কার অধিবাসীদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ইসলাম ধর্মের বিকাশের পর্যায়েও তাই আরবের অন্য অনেক প্রাচীন রীতির মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে হালাল করা হয়েছে। মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র ও ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.), হজরত ওমর ফারম্নক (রা.) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.), হজরত উসমান গনী যুন্নুরাইন (রা.) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.) এবং সর্বশেষ খলিফা জ্ঞানের দরজা খ্যাত হজরত আলী বিন আবু তালিব (রা.) (৬৫৬-৬৬১ খ্রি.)-এর সময়ে বণিক সম্প্রদায় নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত।
মহান খলিফাদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী। তিনি ওই কাপড়ের ব্যবসা করেই বিত্তশালী হন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সময় তিনি প্রায় ৪০ হাজার দিনারের মালিক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কোরাইশদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছল ও সুখী ব্যবসায়ী ছিলাম।’ জাহেলিয়া যুগে তিনি অনেক বারই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে ব্যবসায়ের উদ্দেশে দূরদেশ সফর করেছেন। ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি ব্যবসায়ের উদ্দেশে দূরদূরামেত্ম সফর করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের এক বছর আগেও তিনি ব্যবসায় উপলÿÿই বসরা গমন করেন। তবে মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি খেলাফতের গুরম্নদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনার্থে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর মতো দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারম্নক (রা.)ও ব্যবসায়ী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশে বহু অঞ্চল সফর করেন। ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি নিজেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত রেখেছিলেন। আল্লামা সোলায়মান নদভীর মতে, ‘তার অন্ন সংস্থানের প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা’ (সাহাবা চরিত্র, প্রথম খ-, ইফাবা, ঢাকা : ১৯৮৬, পৃ. ১৭৫)। খিলাফতের মহান দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি নিজের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ চালিয়ে নিতে তিনি ব্যবসা করতেন। ঐতিহাসিক তাবারি, ইবনে সা’দ প্রমুখের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, খলিফা হজরত ওমর ফারম্নক (রা.) যখন শাহাদতবরণ করেন তখন তাঁর কাছে বায়তুল মালের ৮০ হাজার দিরহাম পাওনা ছিল। তিনি ওই অর্থ নিজের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য বায়তুল মাল থেকে ধার হিসেবে নিয়েছিলেন। খলিফা হজরত ওমরের ফারম্নক (রা.)-এর পুত্র আবদুল্লাহ বিন ওমর ও ওবায়দুল্লাহ বিন ওমরও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায় যে, তারা ইরাক থেকে পণ্যদ্রব্য কিনে মদিনায় বিক্রি করতেন। ওই সময়ে শুধু খলিফা বা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাই নন, সাধারণ মানুষও, এমনকি নারীরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনানুযায়ী হিনদা বিনতে উতবা ছিলেন ওই সব ব্যবসায়িক নারীর মধ্যে অন্যতম। হিনদা বিনতে উতবা বনু কেলাবের শহরগুলোতে গমন করে পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা করতেন। খলিফা হজরত ওমর (রা.) ছাড়াও তাঁর প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ওই সব প্রাদেশিক শাসনকর্তার মধ্যে বসরার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশআ’রী ছিলেন অন্যতম।
ইসলামের ইতিহাসের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান গণি (রা.)ও ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি যৌবনের শুরম্নতেই নিজেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত করেন। সততা, বিশ্বসত্মতা, সত্যনিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ে বিপুল অর্থ-সম্পদের অধিকারী হন। তৎকালীন আরবে তাঁর চেয়ে বিত্তশালী ব্যবসায়ী আর কেউ ছিলেন না। এই কারণে তাকে ‘গণি’ বলে অভিহিত করা হতো। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) আগে আলোচিত প্রথম তিনজন মহান খলিফার মতো বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি মূলত সৈনিক ছিলেন। তাঁর শৈশব কেটেছে মহাবনী (সা.)-এর গৃহে। ফলে তাকে জীবিকা নির্বাহের চিমত্মা করতে হয়নি। হিজরতের পর হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ হলে তিনি পৃথক গৃহে বসবাস করতে শুরম্ন করলেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য কাঠ বিক্রি করতেন। যুদ্ধ অভিযান থেকে প্রাপ্ত গনিমতের অর্থও তাঁর সংসারের খরচে ব্যয় হতো।
পরিশেষে খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে শুধু মুসলিমরাই ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন এমন নয়, অমুসলিমরাও ওই সময়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতেন। এমনকি বিদেশি অমুসলিম বণিকরাও খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র আমাদের নিশ্চিত করেছে। 
Previous
Next Post »